Tafsir Ahsanul Bayaan

Multiple Ayahs

Tags

Download Links

Tafsir Ahsanul Bayaan tafsir for Surah Al-Muzzammil — Ayah 20

তোমার প্রতিপালক তো জানেন যে, তুমি জাগরণ কর কখনো রাত্রির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনো অর্ধাংশ এবং কখনো এক-তৃতীয়াংশ এবং জাগে তোমার সাথে যারা আছে তাদের একটি দলও।[১] আর আল্লাহই নির্ধারিত করেন দিবস ও রাত্রির পরিমাণ।[২] তিনি জানেন যে, তোমরা এর সঠিক হিসাব কখনও রাখতে পারবে না,[৩] তাই তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন।[৪] কাজেই কুরআনের যতটুকু আবৃত্তি করা তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর।[৫] আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ-সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে[৬] এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে।[৭] কাজেই কুরআন হতে যতটুকু সহজসাধ্য আবৃত্তি কর,[৮] নামায প্রতিষ্ঠিত কর,[৯] যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ।[১০] তোমরা তোমাদের আত্মার মঙ্গলের জন্য ভাল যা কিছু অগ্রিম প্রেরণ করবে, তোমরা তা আল্লাহর নিকট উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসাবে মহত্তর পাবে।[১১] আর তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

[১] যখন সূরার শুরুতে অর্ধরাত অথবা তার কিছু কম-বেশী কিয়াম করার (তাহাজ্জুদ নামায পড়ার) আদেশ দেওয়া হল, তখন নবী (সাঃ) এবং তাঁর সাথে সাহাবা (রাঃ)-দের একটি দল রাতে কিয়াম করতে লাগলেন। কখনো দুই-তৃতীয়াংশের কম, কখনো অর্ধরাত পর্যন্ত, আবার কখনো রাতের এক-তৃতীয়াংশ, যা এখানে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু প্রথমতঃ রাতে ধারাবাহিকতার সাথে এই কিয়াম করা বড়ই কঠিন ছিল। দ্বিতীয়তঃ অর্ধ রাতের অথবা এক-তৃতীয়াংশের বা দুই-তৃতীয়াংশের অনুমান করে কিয়াম করা আরো কঠিন ছিল। তাই মহান আল্লাহ এই আয়াতে লঘুকরণের নির্দেশ অবতীর্ণ করলেন। যার অর্থ কারো কারো নিকট, কিয়াম ত্যাগ করার অনুমতি। আর কারো নিকট এর অর্থ হল, তাঁর (কিয়ামের) ফরযকে মুস্তাহাবে পরিবর্তন করণ। এখন এটা না উম্মতের উপর ফরয, আর না নবী (সাঃ)-এর উপর ফরয। কেউ কেউ বলেছেন, এটা কেবল উম্মতের জন্য হাল্কা করা হয়েছে। নবী (সাঃ)-এর জন্য তা পড়া জরুরী ছিল।[২] অর্থাৎ, মহান আল্লাহই মুহূর্তগুলো গণনা করতে পারেন যে, তা কতটা অতিবাহিত হয়েছে এবং কতটা অবশিষ্ট আছে। তোমাদের জন্য এর অনুমান করা অসম্ভব ব্যাপার।[৩] রাত কতটা অতিবাহিত হয় --তা জানা যখন তোমাদের পক্ষে সম্ভবই নয়, তখন তোমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাহাজ্জুদের নামাযে কিভাবে মগ্ন থাকতে পার?[৪] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা রাতের কিয়ামের অপরিহার্যতা রহিত করে দিয়েছেন। এখন কেবল তার ইস্তিহবাব (পড়লে ভাল --এই মান) অবশিষ্ট রয়েছে। আর তাও নির্দিষ্ট ওয়াক্তের ধরাবাঁধা কোন নিয়ম ছাড়াই পড়া যায়। অর্ধরাতের, রাতের এক তৃতীয়াংশের অথবা দুই তৃতীয়াংশের নিয়মিত অভ্যাস বজায় রাখাও জরুরী নয়। যদি কেউ সামান্য সময় ব্যয় করে দু' রাকআতই পড়ে নেয়, তবুও সে আল্লাহর নিকট রাতে কিয়াম করার নেকী পাওয়ার অধিকারী হয়ে যাবে। তবে কেউ যদি রসূল (সাঃ)-এর অভ্যাস অনুসারে ৮ (এবং বিত্র সহ ১১) রাকআত তাহাজ্জুদ নামায পড়তে যত্নবান হয়, তাহলে তা হবে সর্বাধিক উত্তম এবং সে নবী (সাঃ)-এর ভক্ত অনুসারী গণ্য হবে।[৫] فَاقْرَأُوْا (কুরআনের যতটুকু আবৃত্তি করা তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর) এর অর্থ হল, فَصَلُّوْا (তোমরা নামায পড়)। আর 'কুরআন' বলতে এখানে الصَّلاَةَ (নামায) বুঝানো হয়েছে। যেহেতু তাহাজ্জুদের নামাযে কিয়াম (দাঁড়ানো) অনেক লম্বা হয় এবং কুরআন খুব বেশী পড়া, তাই তাহাজ্জুদের নামাযকেই কুরআন বলে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন, নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া একান্ত জরুরী হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ হাদীসে ক্বুদসীতে এটা (সূরা ফাতিহা)-কে 'নামায' বলে আখ্যায়িত করেছেন, قَسَّمْتُ الصَّلاَةَ بَيْنِي وَبَيْنَ عَبْدِي । কাজেই 'যতটুকু কুরআন পড়া সহজ হয়, ততটুকু পড়'এর অর্থ হল, রাতে যত রাকআত নামায পড়া সহজসাধ্য হয়, তত রাকআত পড়ে নাও। এর জন্য না সময় নির্ধারণের প্রয়োজন আছে, আর না রাকআতের ব্যাপারে কোন ধরাবাঁধা সংখ্যা আছে। এই আয়াতের ভিত্তিতে কেউ কেউ বলেছেন যে, নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী নয়। যার জন্য কুরআনের যে অংশ পড়া সহজ, সে তা পড়ে নেবে। কেউ যদি কুরআনের যে কোন স্থান থেকে একটি আয়াতও পড়ে নেয়, তারও নামায হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথমতঃ এখানে কুরআন বা 'ক্বিরাআত' অর্থ নামায যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। অতএব আয়াতের সম্পর্ক এর সাথে নেই যে, নামাযে কতটা ক্বিরাআত পড়া জরুরী? দ্বিতীয়তঃ যদি মেনেও নেওয়া যায় যে, এর সম্পর্ক ক্বিরাআতের সাথে, তবুও এ দলীলের মধ্যে কোন শক্তি নেই। কেননা, مَا تَيَسَّرَ তফসীর স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, কমসে-কম যে ক্বিরাআত ব্যতীত নামায হয় না তা হল, সূরা ফাতিহা। এই জন্যই তিনি বলেছেন, এটা (সূরা ফাতিহা) অবশ্যই পড়। যেমন সহীহ এবং অত্যধিক শক্তিশালী ও স্পষ্ট হাদীসমূহে এ নির্দেশ রয়েছে। নবী করীম (সাঃ) এর ব্যাখ্যার বিপরীত এই বলা যে, 'নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী নয়, বরং যে কোন একটি আয়াত পড়লেই নামায হয়ে যাবে' বড়ই দুঃসাহসিকতা এবং নবী (সাঃ)-এর হাদীসকে কোন গুরুত্ব না দেওয়ারই নামান্তর। অনুরূপ এটা ইমামদের উক্তিরও বিপরীত। তাঁরা উসূলের কিতাবগুলোতে লিখেছেন যে, এই আয়াতকে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার দলীল হিসাবে গ্রহণ করা ঠিক নয়। কারণ, দু'টি আয়াত পরস্পর বিপরীতমুখী। তবে কেউ যদি জেহরী (মাগরেব, এশা, ফজর, জুমআহ, তারাবীহ, ঈদ প্রভৃতি) নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ে, তাহলে ইমামদের কেউ কেউ কোন কোন হাদীসের ভিত্তিতে তা জায়েয বলেছেন। আবার কেউ তো না পড়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। (বিস্তারিত জানার জন্য 'ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী' এ বিষয়ে লিখিত কিতাবসমূহ দ্রষ্টব্যঃ)[৬] অর্থাৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কাজ-কর্মের জন্য সফর করবে। এক শহর থেকে অন্য শহরে অথবা এক দেশ থেকে অন্য এক দেশে যাতায়াত করবে।[৭] অনুরূপ জিহাদেও সফরের কষ্ট ও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আর এই তিনটি জিনিসেরই --অসুস্থতা, সফর এবং জিহাদ-- পালাক্রমে সকলেই শিকার হয়ে থাকে। এই জন্য আল্লাহ তাআলা রাতে কিয়াম করার জরুরী নির্দেশকে শিথিল করে দেন। কেননা, এই তিনটি অবস্থাতে এ কাজ অতি কঠিন এবং বড়ই ধৈর্যসাপেক্ষ কাজ।[৮] শিথিল ও হাল্কা করার কারণসমূহ বর্ণনার সাথে এখানে পুনরায় উক্ত নির্দেশ হাল্কা করার কথাকে তাকীদ স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে।[৯] অর্থাৎ, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায।[১০] অর্থাৎ, আল্লাহর রাস্তায় প্রয়োজন ও সাধ্যমত ব্যয় কর। এটাকে 'ক্বারযে হাসানা' (উত্তম ঋণ) নামে এই জন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ এর পরিবর্তে সাতশ' গুণ বরং তার থেকেও বেশী সওয়াব দান করবেন।[১১] অর্থাৎ, নফল নামাযসমূহ, সাদাকা-খয়রাত এবং অন্যান্য যে সব সৎকর্মই করবে, আল্লাহর কাছে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট ২০ নং এই আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই জন্য তাঁরা বলেন যে, এর অর্ধেক অংশ মক্কায় এবং অর্ধেক অংশ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। (আইসারুত্ তাফাসীর)